আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সেদিন ট্রেনে যাচ্ছিলাম। আমি যেখানে বসে ছিলাম ঠিক তার উল্টো দিকের সিটে চারজন অল্প বয়সের ছেলে মেয়ে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিল। কথা শুনে বা দেখেই মনে হলো সদ্য ইস্কুল গন্ডি পেরিয়েছে।
নিজের স্বভাব অনুযায়ী শুরু করলাম তাদের সাথে আলাপচারিতা। কথায় কথায় জানলাম তাদের বর্তমান অবস্থার কথা। জিজ্ঞাসা করলাম ‘জীবন বলতে কি বোঝো’? একসাথে জোরালো গলায় বলে উঠলো ‘এনজয়’।
বল্লাম তার জন্য যা যা দরকার সবকিছু কি ঠিকঠিক আছে? জীবনের প্রয়োজন কি মিটবে বলে মনে করছো? একটি মেয়ে বলে উঠলো নিশ্চয়ই মিটবে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছি আমরা এখন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছি। পরে ভালো চাকরি করবো তারপর মোটা মাইনের চাকরি করা ছেলে কে বিয়ে করে হয়তো বা বিদেশে সেটেল করবো ব্যাস আর কি চাই?
বাকি তিনজন ছেলে মেয়ে তার সাথে সুর মিলিয়ে অনেক কিছু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। আমি একটু চুপ করে থেকে বল্লাম ‘জলের আরেক নাম জীবন’ এটা তো নিশ্চয়ই জানা আছে?
জল তো পৃথিবীর বুকে কমতে শুরু করেছে তার জন্য আমাদের তো একটু সচেতন হওয়া দরকার তোমরা কি বলো? তিনজন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো হুম কোথায় যেন শুনলাম কিন্তু তাতে আমরা আর কি করবো? আসলে সারাদিন কলেজ, টিউশনি, করে আর অন্য খবর রাখার সময় পাইনা।
তা ছাড়া সবকিছুর শেষ আছে তাই এতো ভেবে লাভ নেই। সবার যা হবে আমাদের ও তাইই হবে বলতে বলতে হেসে উঠলো। যে মেয়েটি চুপ করেছিল এবার সে থেমে থেমে বলতে লাগল বাকি তিনজনের উদ্দেশ্যে ‘আরে তা নয় আসলে যে ভাবে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মানে বাড়িতে বাবা মা ঐ কি সব গাছ লাগানো নিয়ে আলোচনা করছিল। আমি ঠিক মানে আসলে শুনিনি
তবে যে টুকু বুঝলাম তাতে মানে টা খুব একটা ভালো নয়।
আমি চুপচাপ ওদের আলোচনা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এরাই আমাদের ভবিষ্যত? যারা কি না নিজেদের দেশ, পরিবেশ, পরিস্থিতির কোনো কিছুরই খবর রাখে না। শুধু নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো নিজের ক্যারিয়ার গড়তে ছুটে চলেছে উদভ্রান্ত হয়ে ।
বললাম কেরল সহ কয়েকটি রাজ্যে ভীষণ জল সংকট দেখা দিয়েছে। মাটির নিচে ষাট শতাংশ জল শেষ হয়ে গেছে কোন একদিন আমাদের রাজ্যেও জলের ঘাটতি দেখা যাবে। তা হলে এখন কি উপায়? দেখলাম চারজনের মুখে একটু দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরেছে।
বুঝলাম এখনো ওদের মনটা যান্ত্রিক হয়ে যায়নি। তাই নতুন উদ্যমে শুরু করলাম বোঝাতে। সমাজের অবক্ষয় বাঁচাতে আমাদের কেই তুলে নিতে হবে গুরু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধবংসের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।
আমাদের উন্নতির দরকার কিন্তু পরিবেশকে ধবংস করে নয়। আজ যাকে আমরা বন ভূমি বলছি উন্নতির উন্মাদনায় সেটাই কাল হয়ে যাবে জনভূমি। নিজেদের স্বার্থে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে বদলে সিমেন্ট, ইঁট,পাথর লোহালক্কড়ের জঙ্গল বাড়ছে। সারা বছর ধরে উন্নতির নামে আমরা যে বনভূমি ধবংস করছি বদলে কটা গাছ রোপণ করছি?
‘একটা গাছ একটা প্রান’ অথচ আমরা অবলীলায় প্রান নিচ্ছি কিন্তু প্রান বাঁচাতে কিছু করছি কি? পুকুর, জলাশয় বন্ধ করে বড়ো বড়ো বিল্ডিং উঠছে, পাহাড় কেটে হোটেল, নদী সংস্করণ বন্ধ। প্রকৃতি কে দিনের পর দিন নিষ্ঠুর ভাবে অপব্যবহার করছি এবার প্রকৃতিও ফিরিয়ে দিচ্ছে তার জবাব।
আর বেশি দিন নেই পৃথিবীর বুকে জল নিঃশেষ হতে। আমাদের পাশাপাশি কয়েকটি রাজ্যে সোনার দরে জল বিক্রি হচ্ছে আমরাও এগিয়ে চলেছি সেই একই পথে।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে চারজনের একজন বলে উঠলো আমরা দেশে এতো মানুষ কেন সবাই কিছু ব্যাবস্থা করছে না, আর কি ভাবেই বা জল বাঁচতে হবে?
বললাম দেখ আমাদের প্রথমেই অঙ্গীকার করতে হবে। আমরা প্রতি টি মানুষ নিজের পরিবারের সব সদস্য হিসেবে একটি করে গাছ লাগাবো আর শুধু লাগাবোই না, গাছটি বড়ো না হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও করবো।
প্রতি টি বাড়িতে যাদের কোমট পায়খানা আছে তা তুলে ফেলবো,বাথটব, শাওয়ারের স্নান বন্ধ করতে হবে। রান্না ঘরে আগেকার মতো বালতির জলে রান্না বাসনমাজা করতে হবে। বৃষ্টির জল যেন জলাধারে সঞ্চয় করা যায় তার ব্যাবস্থা করতে হবে।
মনে রেখো মাটি থেকে যতটা জল তুলবে ঠিক ততটাই মাটি শুকিয়ে যাবে জল ফেরত দেবার জায়গা নেই মাটি কে তাই জলের অপচয় বন্ধ করতে হবে সবার আগে।
সব শেষে বলি যে কোনো উৎসবের উপহার হোক গাছের চারা । কে কেন কি করলো বা না করলো আলোচনা করে সময় নষ্ট না করে নিজেরাই শুরু করো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি স্টেশনে ঢুকল ট্রেন।
যেহেতু একই জায়গার বাসিন্দা তাই সবাই মিলেই নেমে পড়লাম । স্টেশনের বাইরে এসে ওরা বললো আজ আপনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন তাই চলুন, আমরা একে অপরের কে গাছের চারা কিনে দিয়ে সম্পর্কের সম্মান জানাই।
‘গাছ লাগান জল বাঁচান/ অঙ্গীকারের সাথী হন’।
জোর গলায় বলতে বলতে ছেলে মেয়েদের দল এগোতে লাগল আর আমি ওদের পেছনে ভাবতে ভাবতে এগোতে লাগলাম কে বলে আমাদের ‘ভবিষ্যৎ’ অন্ধকার?
ঐ তো শক্ত হাতে হাল ধরতে জোর কদমে এগোচ্ছে আমাদের ‘ভবিষ্যৎ’। তাই আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে- একটি গাছ একটি প্রান /
জল বাঁচান, নয়তো সব হবে খানখান’।
লেখক- কবি ও গল্পকার। পশ্চিমবঙ্গ, কলিকাতা।