=========== অশ্রু বড়ুয়া রূপক।
গত শতকের ষাট দশককে বলা হয়- আধুনিক বাংলা গানের জাগরণ পর্ব বা স্বর্নযুগ। ওই সময় আমাদের দেশে ভারতীয় বাংলা আধুনিক গানের শিল্পীদের বিস্তর প্রভাব ছিল। ঠিক তেমনি সময়ে বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রতিভাধর, মেধাবি একঝাঁক গুণী শিল্পীর আর্বিভাব ঘটে। ওইসব শিল্পীরা নিজেদের সঙ্গীত প্রতিভাকে কাজে লাগান অকুন্ঠ সাধনায়। এরি ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। তেমনি সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গীত অঙ্গনের অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাম- সুবীর নন্দী।
ইংরেজি ১৯৫৩ সাল। সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দীপাড়া গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন সুবীর নন্দী। বাবা- শুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং সঙ্গীতপ্রেমী। মা- পুতুল রানীও ভালো গাইতেন।
ইংরেজি ১৯৬৩ সাল। তখন সুবীর তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র। মায়ের কাছে প্রথম গান শেখা শুরু হলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন-ওস্তাদ বাবর আলী খান’র কাছে। তবে বিদিত লাল দাস’র কাছে নিয়েছেন লোকগানে তালিম। ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সুবীরের শৈশব কেটেছে বাবার কর্মসূত্রে অবশ্য চা বাগানেই। এভাবেই ১৯৬৭ সালের দিকে সিলেট বেতারে তালিকাভুক্ত হন সুবীর নন্দী।
১৯৭০ সালের কথা। সিলেট পেরিয়ে ঢাকা রেডিওতে প্রথম গান রের্কড করেন সুবীর নন্দী। ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ এই গানটির সুরকার ছিলেন মীর কাশেম। উনিই তাঁকে রেডিওতে গানটি গাইবার সুযোগ করে দেন। ধীরে ধীরে সুবীর নন্দী’র কন্ঠে রোমান্টিক আধুনিক গান ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে।
এরপর ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন গুণী এ শিল্পী।
ওই ছবিতে ‘দোষী হইলাম আমি দয়ালরে’ সুজেয় শ্যামের সুরে গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে ‘মহানায়ক’ চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ‘র সাথে করেন দ্বৈত গান। ‘তুমি চাও প্রিয় নদী’ শীর্ষক গানটির সুর ও সঙ্গীতে ছিলেন শেখ সাদী খান। ওই সময় গানটি পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের সুরের আরেক জাদুকর শেখ সাদী খান’র সুরে সুবীর নন্দী’র কন্ঠে অবশ্য বেশ কিছু গান হয়ে উঠেছে জীবন্ত। মর্মস্পর্শী এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কথার ওইসব গান সুবীর নন্দীর কন্ঠে যেন ফিরে পেয়েছে প্রান। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে বেতার টেলিভিশন থেকে চলচ্চিত্রে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। ১৯৮১ সালে ডিসকো রের্কডিংয়ে ব্যানারে বাজারে আসে বাংলা গানের অন্যতম সুন্দর কন্ঠের অধিকারী সুবীর নন্দী একক অ্যালবাম।
সুবীর নন্দী শুধু গায়কই নন, ছিলেন একজন সঙ্গীত সাধকও। তাইতো আধুনিক গানে সতন্ত্র এবং শৈলী নির্মাণে হয়েছেন সক্ষম। গভীর দরদ আর মমতা দিয়ে গাইতেন গান। গানের বাণীকে উপলব্দি করে সুরের সাগরে তুলতেন ঝড়। তাইতো-হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, আমার এ দুটি চোখ, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে, চাঁদে কলঙ্ক আছে যেমন, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, পাহাড়ের কান্না দেখে, কেনো ভালোবাসা হারিয়ে যায়-সহ অসংখ্য গান সবার মনে সাড়া জাগায়।
গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকুরী করেন সুবীর নন্দী। গানের প্রতি অত্যন্ত মনযোগী, মেধাবি এই শিল্পীকে ‘মহানায়ক'(১৯৮৪) শুভদা (১৯৮৬) শ্রাবণ মেঘের দদিন(১৯৯৯) মেঘের পরে মেঘ (২০০৪) এবং মহুয়া সুন্দরী (২০১৫) চলচ্চিত্রে সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার প্রদান করে। এছাড়াও ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সব্বোর্চ বেসামরিক সন্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
আধুনিক বাংলা গানের ভূবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুবীর নন্দী। শুধু এ প্রজন্মেরই নন, তিনি তাঁর প্রজন্মেরও অনেক শিল্পীর অনুপ্রেরণা।
২০১৯ সালের (৮ মে) আজকের এদিনে সুরের বরপুত্র, কালজয়ী এই কন্ঠশিল্পী সব ছেড়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। দৈহিক ভাবে তাঁর মৃত্যু হলেও আত্মিক ভাবে তিনি বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকাল।
আজ মহান এই শিল্পীর স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর।