অনন্যা অর্পিতা।
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষান্তের শেষ দিন আজ। ৩০ চৈত্র ১৪২৬। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। ঋতুরাজ বসন্তেরও শেষ দিন। পশ্চিমাকাশে ডুবে যাওয়া সূর্য্যের সাথে সাথে বসন্তকে বিদায় জানিয়ে শেষ হবে বাংলা বর্ষ ১৪২৬। আগমনী সকালের প্রথম আলোয় আসবে নতুন বছর ১৪২৭। ঋতুচক্রের পরিক্রমায় শুরু হবে গ্রীষ্মকাল।
বাঙ্গালী জাতি-বাংলা সংস্কৃতি-বাংলা নববর্ষ এযেন এক সুতোয় গাঁথা। সারাদেশে প্রতি বছর ঘটা করে দিনটা উদযাপনও করা হয়। আজ পড়ন্ত সূর্যকে বিদায় দিয়ে শুরু হয় বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানমালা। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক। সমস্বরে ভেসে আসে শতকন্ঠে গান “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা / অগ্নী স্নানে শুচি হোক ধরা”। এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে আজ এ আহ্বান জানায় গোটা বাঙালি জাতি।
কিন্তু এবারের পেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনা ভাইরাস মহামারি আকার দারণ করায় এবছর চৈত্র সংক্রান্তি কিংবা বাংলা নববর্ষ উদযাপন হচ্ছে না। এ নিয়ে বাংলা ভাষা-ভাষিদের মধ্যে চাপা দুঃখবোধ থাকলেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সবাই বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছেন সরকারের সিদ্ধান্ত।
বাংলা সনের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিনটি সনাতন বাঙালির লৌকিক আচারের চৈত্রসংক্রান্তি। বাঙ্গালী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ২৯ চৈত্র থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এদিন ফুলবিউ। সনাতনী আচারের চিরাচরিত রূপ। চৈত্রসংক্রান্তি আর নতুন বর্ষবরণের আনন্দঘন আয়োজন। চৈত্রসংক্রান্তির কিছু অনুষ্ঠান যার প্রয়োজনীয়তা বুঝায় এগুলোর বৈজ্ঞানিক গুণ।
ছোটবেলায় ভাবতাম, এগুলো পরবের (উৎসবের) অংশ। তার মধ্যে একটি হলো ফুল বিউ। ফুল বিউতে বাড়ির দরজা-জানালা নদীর ধারে জন্মানো এক প্রকার কাঁটায় ভরা উদ্ভিদে ফোটা ফুল ও তার সঙ্গে নিমপাতার গোছা দিয়ে সাজানো হতো। তা দেখতে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। এতে নিমপাতার ঔষধি গুণটা খুব জরুরি ছিল ঋতু পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
এ ছাড়া রাতের শেষ প্রহরে মায়েদের দায়িত্ব ছিল ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে বিভিন্ন ঔষধি গুণসম্পন্ন লতাপাতা আগুনে পুড়িয়ে নির্গত ধোঁয়ার চারদিকে (জাক দেওয়া) বৃত্তাকারে ঘোরা এবং তার সঙ্গে গ্রামে প্রচলিত কিছু শ্লোক বলা।
চৈত্র সংক্রান্তি মানে বর্ষ শেষের উৎসব। লোকমেলার আয়োজন। গান-বাজনা,
যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে লোকজ সংস্কৃতির নানা সম্ভার। আবহমানকাল থেকেই বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হয়ে আসা চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণ উদযাপনের গলাটিপে ধরেছে এবার করোনা।
চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
জানা যায়, চৈত্র মাসে স্বামী, সংসার, কৃষি, ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। জিয়ল মাছ (পানিতে জিইয়ে রাখা যায় এমন মাছ) যেমন কৈ শিং মাগুরের ঝোল করে খেতেন তারা। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতো খাবারের ব্যবস্থা।
বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক আর পত্রগুল্ম বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতো- সারা বছরের কৃষি কর্ম ঠিক ছিল। ফলে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা।
গ্রামের নারীরা এ সময় সাঁজগোছ করেন ঘরদোর। মাটির ঘর লেপন করে ঝকঝকে করেন। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে রাখাল। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্না। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলে আপ্যায়ন। গ্রামের গৃহস্থরা এ দিন নতুন জামা কাপড় পরে একে অন্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। জানি, এসবের অনেক কিছুই হবেনা এবার।
চৈত্রসংক্রান্তির আরেকটি বড় উৎসব ‘চড়ক’ পুজো। এবার তাও হবেনা। গ্রামের জনপদে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা না হওয়ায় বিক্রি হবেনা মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা। বিক্রি হবেনা বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি ও দই। হবেনা বায়স্কোপ, সার্কাস, পুতুল নাচ বা কোন হইচই। তবু আজ চৈত্র সংক্রান্তি।
আজ শুধু স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা-
ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো / মানুষ হিসেবে মোদের অজ্ঞতার/ চলছে যে মহামারি, করো পরিত্রাণ / অসীম আধাঁর তুমি, অসীম ক্ষমতার/সুস্থ হয়ে উঠুক, পৃথিবী আবার।।