ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
- ————————————
সমগ্র পৃথিবী দ্রুত উন্নতি হচ্ছে, হবে, হতেই থাকবে কিন্তু মানুষের নৈতিক উন্নতি হচ্ছে না। ভেজালের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাছ ভেজাল, মাংস ভেজাল, সবজী ভেজাল, ঔষধ ভেজাল,পরিবেশ ভেজাল, এমন কী ফরমালিনও ভেজাল হয়ে পড়েছে। ‘ফরমালিন’ নামক ক্যামিকেলটির ভালো একটা দাম থাকার কারণে খাদ্যে এটি ব্যবহার না করে লাশ না পচার ক্যামিকেল ব্যবহার করা হচ্ছে। যে শিক্ষক নৈতিকতা শিক্ষা দিবে তাদের নিকট নৈতিকতা কমে যাচ্ছে। ধর্মগুরুরা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। সমাজকে ভেজালমুক্ত করতে ভেজাল মুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভেজাল মানুষের সংখ্যা কমিয়ে ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়াতে না পারলে ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও ভেজাল মুক্ত সমাজ কায়েম করা যাবে না।
মানুষ যদি পরিশুদ্ধ না হয় আমরা সমাজে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। দুর্নীতি দমক কমিশন করলাম, সে কমিশন যদি দুর্নীতি করে, তার দুর্নীতি দমন করতে আরেকটি কমিশন গঠন করতে হবে। সে দুর্নীতি দমন কমিশনও দুর্নীতি করবে। দুর্নীতি দমনের কমিশনের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দুর্নীতিও বাড়বে। সমস্যা সমাধান হবে না।
রাজার ঘরে এক ব্যক্তি প্রতিদিন চার কেজি দুধ বিক্রি করতো। রাজাকে এক উজির পরামর্শ দিয়ে বললো জাঁহাপনা! দুধ বিক্রেতা দুধে পানি দেয়। রাজা উজিরকে বললো, যাও তুমি আগামীকাল হতে দুধে পানি দেয় কিনা পরীক্ষা করে দেখবে। উজির পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখল দুধ খাঁটি আছে। তারপর দুধ বিক্রেতাকে বললো, তুমি যদি দুধের একটা অংশ আমাকে না দাও তাহলে আমি রাজার নিকট রিপোর্ট করবো তোমার দুধ ভেজাল। দুধ বিক্রেতা বললো, আমি আপনাকে দুধের একটা অংশ দিলে আমি তো লাভ করতে, পারবো না। উজির বললো, আমাকে যে পরিমাণ দুধ দিবে সে পরিমাণ পানি দিলেই হয়। দুধ বিক্রেতা তাই করলেন। রাজা দুধ পান করে বুঝতে পারলেন, পানির পরিমাণ দুধে আরো বেড়ে গেছে। পরীক্ষা করে দুধ ভেজাল মুক্ত করতে রাজা একে একে তিন চার জন এক সাথে দায়িত্ব দিল। ভেজালমুক্ত দুধ খেতে রাজা যত বেশি সংখ্যক মানুষ নিয়োগ করলো ততই দুধের পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকলো। একদিন রাজা দুধ খেতে বসে দেখলেন দুধের সাথে আছে মাছের পোনা। দুধ বিক্রেতাকে ডেকে তার কারণ জানতে চান রাজা। দুধ বিক্রেতাকে বললো, জাহাপনা, দুধে মাছের পোনা নয় আর কিছুদিন পর কাদা আসবে। আপনি যতই ভেজাল মুক্ত করতে চাচ্ছেন ততই ভেজালের পরিমাণ বৃদ্ধিপাচ্ছে। কারণ মানুষগুলো ভেজাল।
যে দেশের নিউ মার্কেট মোড়ে হাজার মানুষের সামনে ট্রাফিক সার্জেন্ট ঘুষ গ্রহণ করে, সে দেশের চার দেওয়ালের ভিতর ঘুষ দুর্নীতি পাপাচার বন্ধ করা সহজ নয়। ৯৫% সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি দুর্নীতি করে। কেউ বড় কেউ ছোট ধরনের দুর্নীতিতে লিপ্ত। কিন্তু হাজারে কয় জনের বিচার হয় ? ব্যাপক নীতিহীন মানুষের আইন দ্বারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই আজ বড় বেশি প্রয়োজন ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়ানো। প্রয়োজন নীতি নৈতিক শিক্ষা।
আমরা হালাল খাদ্য খুঁজি কিন্তু হালাল রুজি খুঁজি না। কিছুদিন পূর্বে চীনের এক ব্যবসায়ী বলেছেন, মুসলমান দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা আজ ডিজিটাল দুনিয়ায় তেমন কিছু আবিষ্কার করে না, যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রের ব্যবসা তাদের হাতে নেই। তারা আমাদের দেশে এসে পৃথিবীর সেরা সেরা কোম্পানির পণ্যের লেবেল লাগিয়ে দুই নাম্বার মালের অর্ডার দিয়ে যায়। তাদের পুরো ব্যবসাটাই হারাম অথচ তারা চীনের রেস্টুরেন্টে বসে হালাল খাদ্য খোঁজে। এই হলো আজকের মুসলমানদের অবস্থা।
আমাদের এককালে অভাব ছিল কিন্তু এতো বেশি অভাব বোধ ছিল না। আধুনিক জগতে আমাদের এত বেশি অভাব নেই কিন্তু প্রচণ্ড অভাববোধ দেখা দিয়েছে। প্রচণ্ড অভাববোধ মানুষকে অসুখি করে। সবর শুকর সন্তুষ্টি নেই আজ আমাদের মনে। অত্মসন্তুষ্টি না থাকলে মানুষ কখনো সুখি হতে পারে না। লোভির লোভ শেষ কোথায়! পৃথিবীটা লেখে দিলেও লোভির লোভ শেষ হবে না। অঢেল সম্পদ যদি মানুষকে সুখি করতো তাহলে পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য সুইজারল্যান্ড, উন্নত রাষ্ট্র জাপানের মানুষ আত্মহত্যা বেশি করতো না। শারিরীক সুখের জন্য বিদ্যুৎ, এসি, গাড়ী, প্লেইন, অট্টালিকা, আরামদায়ক বিছানাসহ কত কিছু আবিষ্কার করলাম, শারীরিক চিকিৎসার জন্য কতশত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলাম তার নেই কোন ইয়ত্তা। কিন্তু আমরা তো মানসিকভাবে সুখি হতে পারছিনা। এত কিছু আবিষ্কারের পর মানুষ যদি সুখি হতো তাহলে বিশ্বব্যাপী ঘুমের ঔষধ সেবন বৃদ্ধি পেত না। আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পেত না। টাকা দিয়ে বিছানা কেনা যায় কিন্তু ঘুষ কেনা যায় না।
উন্মাদ হয়ে সবাই টাকার পিছনে দৌড়ছি, এসব অঢেল সম্পদ কী কাজে আসবে ! জীবনাবসানের সাথে সাথে রুহ আজরাইলের, সম্পদ ওয়ারিশের, মাংস পোকা মাকড়ের হাড় মাটির, শুধই নেক আমাল আপনার সঙ্গী হবে। টাকা কবরে চলে না। সাথে নেওয়াও যায় না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘দি-লাস্ট জ্যাকেট হেড নো পকেট’, শেষ কাপড়ের (কাফনের কাপড়) কোন পকেট থাকে না।
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেড মৃত্যুর পূর্বে তার পরিষদকে বলে যান তিনটি কাজ যেন তারা মৃত্যুর পর করে। একটি হলো, টাকা পয়সা, সোনা, রুপা, ডায়মন্ডসহ তার জমানো সম্পদগুলো কফিন নেওয়ার সাথে ছড়িয়ে দেয়। তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব সম্পদ আমার কোন কাজে আসলো না। কবরেও নেওয়া গেল না। দ্বিতীয়টি, হলো তাঁর লাশটি যেন ডাক্তারদের কাঁধে তুলে দেয়, কারণ বললেন, ডাক্তাররা দাবি করে তারা মানুষ বাঁচায়। তারা আমার মত বীর ক্ষমতাশালী, সম্পদশালী ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারলো না। তৃতীয় কাজটি হলো, কবরে আমার কফিন নিয়ে যাওয়ার সময় আমার একটি খালি হাত কফিনের বাইরে রাখবে। কারণ বিশ্ববাসী দেখুক বিশ্ববিজেতা বীর আলেকজান্ডার খালি হাতে ফেরত যাচ্ছে। এসব ঘটনা আমরা স্মরণ করি কিন্তু অনুসরণ করি না। অনুসরণের জন্য এসব ঘটনা হতে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। আমাদের মনে রাখা উচিৎ মহান আল্লাহ পাক কালাম পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে বড় আয়াতটি (প্রায় দেড় পৃষ্ঠা) সম্পদ বিষয়ক।
সম্পদ মানুষের দরকার। কিন্তু কতটুকু ? যতটুকু না থাকলে মানুষের নিকট হাত পাততে হবে, যতটুকু না থাকলে মর্যাদা ও চরিত্র রক্ষা করা যাবে না ততটুকু সম্পদের প্রয়োজন আছে। এভাবে সম্পদের পিছনে মেরাথন দৌড়ের অর্থ নেই।
লিও টলেস্টয়ের একটি গল্প মনে পড়ে গেল। এক রাজা এক লোভি প্রজাকে ডেকে বললো, কাল সকালে সূর্য্য উদিত হওয়ার সাথে সাথে দৌড়তে থাকবে। রাজ দরবার হতে দৌড়ানো শুরু করবে এবং সূর্য্যাস্তের আগেই রাজদরবারে ফিরে আসবে। যতটুকু জায়গা দৌড়ে আসবে ততটুকু ভূসম্পত্তির মালিক হবে তুমি। লোকটি অধিক সম্পদের জন্য সকাল হতে এতবেশি দৌড়ল, ক্লান্ত হয়ে রাজ দরবারে এসে স্ট্রোক করে মারা গেল। লোকটিকে সাড়ে তিন হাত মাটিতে সমাহিত করা হলো। তার সম্পদের প্রয়োজন ছিল শেষ ঠিকানা, শেষ ঘরের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা দরকার ছিল। বেশি সম্পদের জন্য দৌড়ানোর অর্থ ছিল না।