============= ইবনুল ওবায়েদ সিকান্দার।
সমগ্র বিশ্ববাসী আজ মারাত্মক বিপদের মাঝে। ইতিহাসের খুব মারাত্মক এক বিভীষিকাময় সময় তামাম দুনিয়া পার করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। মৃত্যুর মিছিল যে আর কত লম্বা হবে তা একমাত্র আরশের মালিক প্রতিপালক আল্লাহই ভালো জানেন। তবে আল্লাহর হাবীব দো-জাহানের সরদার মহানবীর (দ.) দোয়ার বরকতে আমাদের মারাত্মক ক্ষতি হবেনা বলে বিশ্বাস করে মুসলিম বিশ্ব।
একটা হাদীস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা হলে সুরাইয়া নামক এক তারকা মে মাসের ১২ তারিখ উদয় হতে যাচ্ছে। তার কারণে এই দুঃখজাগানিয়া করোনা ভাইরাস বিদায় নেবে। রাসুল (দ.) বলেছেন, “সুরাইয়া সিতারার উদয়ের পর মহামারি, বালা মুসিবত, রোগ ব্যাধি চলে যায় বা রোগ ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে।”
একটা তারকাপুঞ্জ আছে, যার আরবি নাম সুরাইয়া। যেটাকে বাংলায় কৃত্তিকা বলে, ইংরেজিতে বলে Pleiades (প্লায়েডিয)। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এর উদয় ফজরের সময় হয়। এই সময় এই তারকার উদয়ে মানুষের উপর থেকে নানা মহামারি, বালা, মুসিবত ও ব্যাধি বিদায় নিয়ে চলে যেতে পারে বলে একটা সহীহ হাদীস আছে। মনে হয় এই হাদীস নিয়ে একটু আলোচনা হওয়া দরকার।
ইমাম আততাহাওয়ী তার “শারহ মুশকিল আল আসার” গ্রন্থে ইমাম আবু হানিফার সনদে একটা হাদীস নিয়ে এসেছেন। এই হাদীসকে তিনি দূর্বোধ্য হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং অত্যন্ত গভীর পান্ডিত্য দিয়ে তার বিশ্লেষণ করেছেন। হাদীসটাতে আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূল (দ.) বলেছেন, “যখন তারাটি ( সুরাইয়া) উঠবে, তখন প্রতিটি শহরবাসী থেকে বালা মুসিবত ও ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে”।
ইমাম আততাহাওয়ী বলেন, এই হাদীস নিয়ে ভাবতে যেয়ে আমি এই তারকার সন্ধান করা শুরু করলাম। কয়েকটা হাদীস নিয়ে গবেষণা করতে যেয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের হাদীসের সন্ধান পেলাম। তিনি বলছেন, ‘‘মহানবী (সা) ব্যাধি চলে যাওয়ার আগে ফল বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন’’। বর্ণনাকারী উসমান বলেন, আমি ইবনে উমারের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, কখন যাবে সেই ব্যাধি। তিনি বললেন, ঐটা সুরাইয়া সিতারা বা তারকাপুঞ্জ উদয়ের পর।
ইমাম আততাহাওয়ী বলেন, এই হাদীস থেকে আমরা বুঝলাম সুরাইয়া তারকাপুঞ্জ উদিত হলে ব্যাধি চলে যাওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা হলো আরবের তখনকার ফলমূলের ব্যাধি। মূলতঃ গরম আসার আগে বিশেষতঃ বসন্তের সময় খেজুরে রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ঐটা চলে যায় সুরাইয়া উঠলে। আরো হাদীস গবেষণা শুরু করলাম কোন সময়ে এই সুরাইয়া বা প্লায়েডিয উদয় হয় তার কথা কোন হাদীসে পাওয়া যায় কিনা।
গবেষণায় আবু হুরায়রার বর্ণিত আরেকটা হাদীস পেলাম যেখানে মহানবী (সা) বলছেন, “সকালে তারকাটা উঠলে মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ব্যাধি আল্লাহ উঠিয়ে নেন, অথবা কমিয়ে দেন”।
আমি বুঝলাম যে সুরাইয়ার এই উদয়টা তাহলে ভোর বেলায় বলা হলো। আমি তখন মিশরীয়ের পঞ্জিকা ঘাটতে থাকলাম। সকালে এই তারকার উদয় তাদের সাল অনুযায়ি বাশান্স মাসে হয়, যেটা তাদের পঞ্জিকায় ঐ মাসের ১৯ তারিখে হয়। এইবার এই ক্লু ধরে ইরাকি পঞ্জিকায় এই মাসকে মিলিয়ে আয়ার (মে মাস)কে পেলাম, এবং এই মে মাসের ১২ তারিখ এই তারা সকালে উঠে বলে জানলাম।
এরপর ইমাম আততাহাওয়ী আবু হুরায়রার আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেন। যেখানে বলা হচ্ছে, মহানবী (সা) বলেন,
إِذَا طَلَعَتِ الثُّرَيَّا صَبَاحًا رُفِعَتِ الْعَاهَةُ عَنْ أَهْلِ الْبَلَدِ
“যখন সকালে সুরাইয়া উঠবে তখন শহরবাসিদের কাছ থেকে ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে।”- শারাহ মাআনি আলআসার, ৪/২৩।
এরপরে ইমাম আততাহওয়ী বর্ণিত এই হাদীসগুলো নিয়ে যথেষ্ঠ গবেষণা হয়েছে।
ইমাম আহমাদের মুসনাদের হাদীস, ইমাম মুহাম্মাদের “আলআসার”এর হাদীস, এবং খেজুর বিক্রি সংক্রান্ত সব হাদীসগুলো একত্রে আনলে আবু হুরায়রার হাদীসকে হাসান বা সহীহ সাব্যস্ত করা যায়, এবং ইবন উমারের হাদীসকে সহীহ মানতে হয়।
যা হোক এই হাদীসগুলোর সাধারণ আলোচনা ছিলো একটু ভিন্ন। তা হলো আরব পঞ্জিকায় শীতকাল শুরু হয় ইংরেজির অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে। ঐ সময়ে সুরাইয়া নামের এই নক্ষত্রপুঞ্জ সন্ধ্যার পর উদয় হতে থাকে। রাত গভিরে তখন এই তারা খুব সহজে দেখা যায়।
সৌরজগতের এই সুরাইয়াকে অনেকে “তিত পুঁটির ঝাঁক” বলেন। এটা ৬ বা ৭ বা ৯ বা ১১ তারকার একটা পুঞ্জ যা অক্টোবরের আকাশে খালিচোখে সুন্দর ভাবে দেখা যায়। কিন্তু এই পুঞ্জে আছে আরো ২৫০টা সংগী তারকা, যারা এক সাথেই কক্ষপথে “পুঁটি মাছের” ঝাঁক মত বেঁধে চলে। সপ্তদশ শতকে গ্যালিলির টেলিস্কোপে পাওয়া তথ্যে তার গতিময়তার বর্ণনা আছে। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এই তারকাপুঞ্জ রাত কিছু গভীর হলে উদয় হয়। তখন বেশ বৃষ্টি হয়। আরব দেশগুলোতে তখনই বসন্তের পূর্ণতার সময়।
এরপর থেকে শুরু হয় নানা রকম ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ার প্রাদূর্ভাব। একে তো সূর্যের প্রখরতার অভাব, আরো রাতগুলোর দীর্ঘতা ও দিনগুলোর হ্রাস্যতা। এই সব কারণে পৃথিবীতে অনেক ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যায়। কখনো তা মহামারির রূপ নিয়েও আসতে পারে। যেমন এবার এসেছে করোনা ভাইরাস। এই সময়টা আসলে দুনিয়ার জন্য খুবই কষ্টের সময়।
এবারের করোনা ভাইরাস তাই জানান দিচ্ছে।
আস্তে আস্তে সূর্য তার উদয়স্থল পরিবর্তন করে উত্তর গোলার্ধের দিকে সরতে থাকে, ফলে গাছে গাছে অংকুরোদ্গম হতে থাকে। ঘাসে বনজ-বনফুলের সমারোহ শুরু হতে থাকে। আর ভাইরাসের সংক্রমনও বাড়তে থাকে সমান্তরালে। ফসল এবং ফলমূলের রেনু বাতাসে ছড়ালেই শুরু হয় জ্বর, সর্দি, কাশি, ফ্লু ইত্যাদি।
এপ্রিল আসার পর সূর্য আরব অঞ্চলে মোটামুটি জোর পায়। সুরাইয়ার উদয় হয় তখন শেষরাতে। এইভাবে মে মাসের ১২ তারিখের দিকে তার উদয় আসে ফজরের পর। এই সময় আরবদেশে মারাত্মক গরম শুরু হয়। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে শুরু হয় উষ্ণতার আবহ। ফলে পরিবেশ হয়ে ওঠে অনেকটা ভাইরাস মুক্ত। কারণ গরমে ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া বাড়তে কষ্ট পায়। শেনা যায় গরম তীব্র হলে করোনা ভাইরাসও নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমাদের নবী (দ.) ওইটাই বুঝিয়েছেন তাঁর হাদীসগুলোতে। তিনি মূলতঃ এখানে দুটো বিষয়ের অবতারণা করেছেনঃ
১- মে মাসে সুরাইয়ার উদয়কে ফসল সুন্দর হবার ক্ষণ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। ঐ সময় খেজুরসহ ফলমূল বিক্রির জন্য ভাল, কারণ খেজুরে কোন ব্যাধি ও শষ্যে কোন পোকা থাকেনা। কাজেই মে মাসের পর থেকেই খেজুর কেনা বেচার মওসুম ধার্য্য হলে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই জনেই সমস্যামুক্ত হবে।
২- সুরাইয়া যখন সকালে উদয় হওয়া শুরু করে, অর্থাৎ মধ্য মে থেকে সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে। সাথে সাথে শীতের কারণে যে সব পরিবেশিক সমস্যার সৃষ্টি হয় তা কমতে শুরু করে। মহামারি বা যেকোনো রোগ চলে যায়। এই সত্যটি তিনি উচ্চারণ করেছেন।
এই হাদীসগুলো পড়লে আমাদের বর্তমান প্রক্ষিতে করোনার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ও আশাহীন মানবতা অনেক আশার আলো লাভ করে। কারণ গরমের আগমন হচ্ছে, তাই হাদীস অনুযায়ী রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও কমতে শুরু করবে। এইটাই হলো ঐ সুরাইয়া, কৃত্তিকা বা প্লায়েডিয নক্ষত্রপুঞ্জ উদয়ের ব্যাপারে হাদীসগুলোর মর্মকথা। আর সকল বালা মুসিবতের সেফা হচ্ছেন নবীয়ে আখেরোজ্জাহা হুজুর পুর নূর (দ.)।
এখানে আমাদের যে জিনিষটা মাথায় রাখতে হবে তা হলো সারা বছর সূর্য, চন্দ্র ও তারকা রাজির আকর্ষণের কারণে জলবায়ূর যথেষ্ট পরিবর্তন হয়। একজন হাদীস বিশারদ সৌরজগতের তারকার অবস্থানের সাথে জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে বলেন, চাঁদ সূর্য ও সূরাইয়ার কক্ষপথের অবস্থান সমান বিন্দুতে এলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এইটা প্রাকৃতিক সিস্টেমের মধ্যে আল্লাহ দিয়েছেন। যেমনভাবে দিয়েছেন চাঁদের আকর্ষণে জোয়ারের স্ফিতি, ও তার বিকর্ষণে ভাটার টান। এই সিস্টেমের প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস করলে গুনাহ নেই। কেউ যদি বলে চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার ভাটা হয়, তা হলে এই কথায় কোনো গুনাহ হবে না। কিন্তু যখন বলা হয় আল্লাহ নন, চাঁদই এই কাজটা করে, তখন হয় শিরক।
সপ্তম হিজরিতে মক্কার কাফিরদের সাথে সন্ধির সময় আমাদের নবী (সা) হুদায়বিয়্যাহতে অবস্থান করেন কয়েকদিন। একদিন সকালে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এরপর তিনি সাহাবিগণের দিকে ফিরলেন। ঐ রাতে বেশ বৃষ্টি হয়। তিনি বললেন, আজ তোমাদের রাব্ব আল্লাহ তাআলা কি বলেছেন জানো? সাহাবিগণ বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন।”
তিনি বললেনঃ
أَصْبَحَ مِنْ عِبادي مُؤْمِنٌ بِيَ وَكافِرٌ، فَأَمّا مَنْ قَالَ مُطِرْنا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِيَ وَكافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمّا مَنْ قَالَ مُطِرْنا بِنَوْءِ كَذا وَكَذا فَذَلِكَ كافِرٌ بِيَ وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ
এই সকালে আমার বান্দাদের কেউ কেউ আমার উপর ঈমান নিয়ে জেগেছে, কেউ কেউ হয়েছে কাফির। যে বলেছে, আমরা আল্লাহর রহমতে ও তাঁর কৃপায় বৃষ্টি দ্বারা সিঞ্চিত হয়েছি, তারা আমার উপর বিশ্বাসী, এবং তারকায় অবিশ্বাসী। কিন্তু যে বলেছে আমরা ঐ ঐ তারকার জন্য বৃষ্টি পেয়েছি, তারা আমার প্রতি অবিশ্বাসী ও তারকার প্রতি বিশ্বাসী।
এই হাদীসটা আমাদের ঈমানকে শানিত করে। ইনশাআল্লাহ করোনা আক্রমন কমে আসবে। পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নেবে। আমাদের অনেক ক্ষতিও করবে। সামনে গরমের মৌসুম আসছে, তখন তার তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা ও প্রসার কমে যাবে ইনশাআল্লাহ। তা হবে আল্লাহর রহমতে ও ফজলে। কোনো তারকার শক্তিতে নয়, নয় তাদের প্রভাবে।
তবে আল্লাহর হাবীব রহমতে দো আলম হযরত (দ.) যখন নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে আকাশে সুরাইয়া সিতারা উদয়ের পর বালা, আজাব, গজব চলে যায়, তাঁর এই বাণীর উপর বিশ্বাস না করলে মুসলমানদের ঈমানও হালকা হয়ে যাবে।
=================
কৈফিয়ত ও ঋণশোধ-:
লেখাটি অগ্রজ সাংবাদিক Kamal Hossen এর টাইম লাইন থেকে www.Chattobangla.tv পাঠকদের জন্য সংগ্রহকৃত। যা ইতিপূর্বে আজকের সূর্যোদয় অনলাইন-এ প্রকাশ করা হয়।
মহমারি করোনাকালে এই লেখাটি আমাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়হ ভুমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেরে উঠুক প্রিয় স্বদেশ। সুস্থতা ফিরে আসুক পৃথিবীতে।।
হাদিসের ছবি লেখক কতৃক প্রকাশিত অন্য ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত।।