আজ ঘুম থেকে উঠেই একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল মন টা, আজ প্রায় কুড়ি বছর পরও আবার যাবে সেই জায়গাটায়; এক এক করে,মনের মণিকোঠা থেকে স্মৃতি গুলো ভেসে এসে চোখে ধরা দিয়ে যাচ্ছে…।
আচ্ছা যেদিন প্রথম গিয়েছিল সেদিনও কি এরকমই উত্তেজনা হয়েছিল? কে জানে! সে কবেকার কথা! মনেও নেই সব কিছু ভালো করে।আজ এতবছর পর কলেজের রিইউনিয়নে যাওয়ার ইচ্ছে যে খুব ছিল সুচেতনার তা নয়।
এক প্রকার সদ্য কলেজে ওঠা মেয়ে তপস্যার জোরা-জুরিতেই যেতে হচ্ছে। আর তমালও বললো সেদিন! “যাও না,ঘুরে এসো। ভালো লাগবে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে,সেই যে বিয়ে হলো। আমরা কার্শিয়াং চলে গেলাম,তারপর তো কারুর সঙ্গেই আর যোগাযোগ রাখনি। এমন কি বিয়েতেও মনে পড়েনা কোনো বন্ধু কে ডেকেছিলে বলে…তাই না?”।
না বিয়েতে কাউকে ডাকেনি সুচেতনা। হাজার লোকের হাজার প্রশ্ন থাকতো; যার অধিকাংশের উত্তর সুচেতনা নিজেই জানতো না। শুধু শুধু তাদের ডেকে ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। এমনিও খুব আনন্দ মনে যে বিয়ে করেনি তা তো এতগুলো বছর পর তমাল কে বলা যায়না।
আয়নার সামনে দাঁড়ালো সুচেতনা। তাকে দেখলে কিন্তু কেউ বুঝবে না যে সে নিজে এখন কলেজে পড়া মেয়ের মা! সেই কোন একুশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল,তেইশ বছর হতেই মা হয়ে গেছে। নয়-নয় করে দু কুড়ি বয়স হয়ে গেছে! কিন্তু ফিগার এখনো সুন্দর আছে।
শুধু মামন হওয়ার পর থেকে পেটটা কিছুতেই কমছে না আর…! মনে মনে ভাবলো সুচেতনা।
সে যাই হোক। মেয়ের আজ কলেজ ছুটি।রবিবার। তমালেরও ছুটি। মেয়ে এসে বললো,”মাম্মাম এই লাল শাড়িটা পরো”।
“ধুর; এই বুড়ো বয়সে লাল শাড়ি পরে নাকি কেউ!” মেয়ের প্রতি সুচেতনার চোট্ট উত্তর।
“বুড়ো? মা চল্লিশে কেউ বুড়ি হয়না…। age is just a number”মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সুচেতনা আলমারির সব থেকে নিচের তাক থেকে উঁকি মারা নীল শাড়িটা বের করলো।
শাড়িটার গায়ে হাত বুলিয়ে মনে পড়লো; এটা সুচেতনার মায়ের একটা সিল্কের শাড়ি। সম্ভবত এই শাড়ীটা পরেই সুচেতনা প্রথম গেছিলো কলেজে। আর সেই রবীন্দ্র জয়ন্তীর উৎসবে; যেখানে প্রথম দেখেছিল সপ্তক কে। কলেজের সব থেকে লাজুক ছেলে, কিন্তু সবথেকে গুণী ছাত্র। পড়াশোনা,গান বাজনা,ছবি আঁকা,ক্যাম্পাস যেন একাই মাতিয়ে রাখতো। আর ছিল ভুবন ভোলানো হাসি। সত্যি! এখনো মুখটা সামনে ভাসে সুচেতনার।
“আচ্ছা সপ্তক কি আসবে আজ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো মনে মনে… “। কি জানি; কারুর সঙ্গে তো সেভাবে যোগাযোগ রাখেনি। সপ্তক এখন কোথায়,কি চাকরি করছে জানেই না সুচেতনা। একটা সময় অবশ্য চাইলেই জানতে পারতো। কিন্তু তখন রাগ। অভিমানে। আর মনের কোণে জমানো কষ্টে সপ্তকের থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল।
এত বড় আঘাত দিয়েছিল সপ্তক! না। সেইসময় সপ্তকের মুখ ও দেখতে চায়নি সুচেতনা। আচ্ছা এই শাড়িটা দেখেই সপ্তক আবৃত্তি করেছিল না;
“চুরি করতেম আকাশ ভরা সোনার বরন ছুটি,
নীল অমৃতে ডুবিয়ে নিতেম ব্যাকুল চক্ষু দুটি”
না। মোটেই সপ্তকের প্রিয় ছিল বলে এই শাড়ীটা পরতো না সুচি। তখন কি আর এখনের মতো এত শাড়ি ছিল নাকি! মায়ের এই শাড়ীটার ব্লাউস একদম ঠিক হতো। তাই এই শাড়িটাই পরতো…
নিজের মনেই হেসে ফেলল সুচেতনা। কি এক নস্টালজিয়া নিজের অজান্তেই হেসে উঠে সুচেতনা। আজ এত শাড়ী থাকতেও কি জানি কি মনে করে সেই নীল শাড়ীটাই বেছে নিলো। ঘরের কাজ সামলে,স্নানটান করে,মেয়ে বরের খাবার গুছিয়ে সুচেতনা যখন রেডি হয়েছে তখন ঘড়িতে এগারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে।
“উফ মাম্মাম তুমি কখন যাবে কলেজে? তোমার ফ্রেন্ডসরা তো সব এসে চলে যাবে, যাও। আমি সব গুছিয়ে রাখবো। অলরেডি লেট হয়ে গেছে”। মেয়ের তাড়াতেই যেন অবচেতন মনে গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়ে সুচেতনা। গাড়িতে যেতে যেতে এক এক করে পুরোনো কথা গুলো মনে আসতে থাকে। কলেজের রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে “পুরানো সেই দিনের কথা” গাওয়ার কথা ছিল বিনয়ের, বেশ ভালোই গাইতো বিনয়। কিন্তু কি একটা অসুবিধাতে সে সেদিন আসতেই পারলোনা। তখন তো আর এখনের মতো মোবাইল ফোন ছিলোনা।
সবাই সঙ্গে সঙ্গে জানতে পেরে যাবে যে কেন সুচেতনা আসেনি। পরে অবশ্য বলেছিল,অনেক দূর থেকে আসতো, ট্রেন মিস করেছিলো নাকি;
এখন সেসব অত মনেও নেই সুচেতনার। তবে ভাগ্গিস আসেনি সেদিন বিনয়। তা না হলে সপ্তকের সঙ্গে ডুয়েট টা হতো কি করে! হাততালি তে ফেটে পড়েছিল হলঘর। এখনো যেন কানে বাজে সেই হাত তালির আওয়াজ। সেই তো সবে শুরু, তারপর যখন সপ্তকের সঙ্গে কলেজের বার্ষিকী অনুষ্ঠানে ওথেলো করেছিল ওরা দুজনে, অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার অভিনয় ক্ষমতা দেখে।
ওরা দুজন মানে; যেকোনো অনুষ্ঠান সুপার হিট!সে জুটিতে মিলে গানই হোক, বা শ্রুতি নাটক। তাই তো সবাই তাদের সারা জীবনের মতো একটা সুপার হিট জুটিতে দেখতে চেয়েছিলো। হ্যাঁ সূচেতনাও চেয়েছিলো,কিন্তু আস্ত গোটা তিনটে বছর পেরিয়ে গেলেও কেউ কাউকে মনের কথা বলে উঠতে পারেনি। পুরো কলেজ ভাবতো যে সুচেতনা আর সপ্তক একে ওপরকে ভালবাসে।
কোনোদিনও সপ্তক মুখ ফুটে কিচ্ছু বলেনি, সুচেতনা তবু একটা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো; যখন তমালের সঙ্গে বাবা বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছিল প্রায়! লজ্জার মাথা খেয়ে সুচেতনা চিঠি লিখেছিল সপ্তক কে। সবে কলেজ থেকে পাস করেছে তখন। বাবার বন্ধুর ছেলে তমালের সঙ্গে ওর বিয়ের দেখাদেখি চলছে। সুচেতনা দেবশ্রীর মারফত সপ্তক কে খবর পাঠিয়েছিল।
সপ্তকদের কোনো ফোনও তো ছিল না। ভেবেছিল ক্যান্টিনের পেছনের ওই বকুল গাছটার নীচে
দেখা করে সব মনের কথা বলবে সপ্তক কে।
অথচ; কি অদ্ভুত! কিসপ্তক এলই না। রাগে, অপমানে, দুঃখে, ফিরে এসেছিলো সুচেতনা।প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কখনো কোনো যোগাযোগ করবে না। পছন্দ নয়! সেটা এসেও তো বলতে পারতো। ঐভাবে অপমান করবে তাই বলে!আজও সেইদিনের কথা ভাবতে ভাবতে চোখের ভেতর টা জ্বালা করছিল। কয়েক ফোঁটা জলও জমেছিল হয়তো দূ’চোখের কোণে।
জীবনের প্রথম ভালোবাসার কাছে এইভাবে হেরে গিয়ে ভালোবাসার ইচ্ছেটাই মরে গেছে সুচেতনার। এমন নয় যে, তমাল কে ভালোবাসেনা। তবে এটা যত টা না ভালোবাসা; তারচেয়ে ঢের গুন বেশি কর্তব্য। তমালের সঙ্গে আবোল তাবোল পড়েছে কোনো দিন। কিংবা শেষের কবিতা! না। এগুলো তার একান্ত আপন। মনের খুব গভীরে রাখা সপ্তকের স্মৃতি এগুলো।তমালের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব ফরমাল,বয়সে আট বছরের বড় স্বামী তাই বন্ধু হয়নি কখনো।
সত্যি বলতে কি সূচেতনাও চেষ্টা করেনি তমাল কে বন্ধু করার। একবার বন্ধু কে ভালোবেসে দেখেছে সে। ভালোবাসাও থাকেনা। বন্ধুও থাকেনা। আচ্ছা; সপ্তক তো একবার যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারতো। এভাবে পালিয়ে গেল কেন! যখন কলেজের গেট-এ এসে গাড়িটা ব্রেক কড়লো। আচমকা চিন্তা গুলো ভেঙে গেল।
জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখল কলেজ টা।সদ্য একশো বছর হয়েছে; তাই নতুন করে রং করেছে। ধীরে ধীরে সে গেট দিয়ে ঢুকলো ড্রাইভার কে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়ে,এগিয়ে গেলো ডিপার্টমেন্ট এর দিকে। ডিপার্টমেন্ট এর করিডোরে ঢুকতেই হৈ হৈ করে একটা আওয়াজ পেলো। শাড়ীটা আরেকবার ঠিক করে নিলো সুচেতনা।
দরজা দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকতেই সবাই ফিরে তাকালো,কিছুক্ষনের নিস্তব্ধতা,তারপর সবাই “আরে সূচি যে” বলে হৈ হৈ করে উঠলো। সুচেতনা ভাবতেই পারেনি সবাই ওকে এভাবে মনে রেখেছে। “তোরা মনে রেখেছিস আমায়?” বলাতেই সবাই এক সঙ্গে প্রায় বলে উঠলো, “টপার কে কি ভোলা যায়,তাছাড়া তুই তো সেই এক-ই রকম সুন্দরী আছিস” হাসির লহর উঠলো যেন। কত গল্প,সেই কলেজ কেটে সিনেমা দেখতে যাওয়া,ক্যান্টিনে ফুচকার কম্পিটিশন…সুচেতনা দেখলো, সে কিছুই ভুলে যায়নি,”রাতের সব তারাই আছে,দিনের আলোর গভীরে”।
সারা ক্লাসঘরটায় সুচেতনার চোখ খুঁজছিল সপ্তক কে। হঠাৎ বেঞ্চের একদম লাস্ট রো তে গিয়ে চোখ আটকে গেলো। সেই একই রবীন্দ্র জয়ন্তীর মেরুন পান্জাবীটার মতো পাঞ্জাবি পরে বসে আছে সপ্তক। তার দিকেই চেয়ে আছে। মুখে হাসি হাসি ভাব। সত্যি এই ছেলেগুলো একদমই বদলায় না। মেয়েদের মতো মা হতে তো আর হয়না। বয়স তাই যেন কলেজেই আটকে থেকে যায়। আর মেয়ে গুলো বিয়ে করে,বাচ্চা হয়ে এক একজন মাসিমা-কাকিমা হয়ে গেছে। নিজের মনেই হাসলো সুচেতনা।
সত্যি একদম পাল্টায় নি সপ্তক। মনে হচ্ছে যেন সেই কলেজের শেষ দিনটাতে যেমন দেখেছিল, সেরকম-ই আছে। শুধু হাঁসা ছাড়া সুচেতনা কিছুই বলতে পারল না। একরাশ কান্না এসে ওর গলা বন্ধ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিলো,পাছে সপ্তকের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। না কিছুতেই আর তাকাবে না সপ্তকের দিকে। নাহলে এতদিনের জমা প্রেম, অভিমান হয়ে ঝরে পড়বে ওর চোখ দিয়ে।
কিছুক্ষণ এর ওর সঙ্গে কথা বললো, হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তে দেখলো, সপ্তক ইশারা করে ওকেই ডাকছে। একবার ভাবলো যাবে না।কিন্তু সপ্তকের প্রতি ওর মন আজও দুর্বল তাই পারলো না আটকাতে নিজেকে। গল্প করতে করতে পাশে পাশে হাঁটছিল ওরা। “কিরে তুই তো একটুকুও বদলাসনি, এখনো ইসিলি কলেজে স্টুডেন্ট হিসেবে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়” বলে হাসলো সূচি।
সপ্তক লাজুক হেসে বললো,”কি করবো বল,তোদের মতো বিয়ে করে মা হইনি তাই হয়তো বয়সটা কলেজেই আটকে থেকে গেছে” সপ্তক বিয়ে করেনি শুনে কেন কে জানে সুচেতনার বেশ আনন্দ হলো। সে নিজেও বুঝলো না এই আনন্দের কারণ। শুধু বললো,”সেকি বিয়ে করিস নি কেন?” সপ্তক বললো,”কি করবো হঠাৎ ই বাড়ি থেকে এত দূরে চলে যেতে হয়েছিল, ফিরে যে বিয়ে করবো তার উপায় নেই”।
তুইও তো ছিলি না তখন, বিয়ে করে নিয়েছিলি না?”পাল্টা প্রশ্ন করে সপ্তক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুচেতনা; তারপর বলে,”আমায় বিয়ে করার এতই ইচ্ছে থাকলে সেদিন যেখানে আসতে বলেছিলাম আসিসনি কেন?” প্রশ্নটা করেই সুচেতনার মনে হলো ও ঠিক করেনি। আবার একবার অপমানিত হবে, সপ্তক তো ইয়ার্কি করে নিশ্চই বলেছে কথা গুলো। ওর এইভাবে নিজের দুর্বলতা টা দেখিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। সপ্তকের মুখ টা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল, সে বলল,”আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মা এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে সঙ্গে সঙ্গে মা কে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিল, তখন তো এখনের মতো মোবাইল ছিল না, যে তোকে জানিয়ে দেব।
মায়ের ভর্তি,চিকিৎসা তে অনেক সময় লেগে গেছিলো। মায়ের রক্তের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে হয়েছিল, এসেছিলাম তাও এখানে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুই চলে গেছিলিস। সব থেকে বড় কথা কি জানিস এত করেও মা কে বাঁচাতে পারলাম না। অনেক দূরে এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। আজ এলাম শুধু তোকে এই কথাটা বলতে যে সেদিন আমি এসেছিলাম। দেরিতে হয়তো, কিন্তু এসেছিলাম” বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো সপ্তক।
সুচেতনার চোখে কান্না আজ বাঁধ মানছে না।নিজের ওপর-ই তার রাগ হচ্ছে। সেদিন যদি আরেকটু অপেক্ষা করতো। রাগ করে বিয়ে না করে যদি আরেকবার দেখা করতে যেত সপ্তকের বাড়ি। তাহলে সব কিছু হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। নিজের চোখের জল নিজে মুছে সপ্তক বললো আবার,”অবশ্য ভালোই হয়েছে সেদিন আমাদের দেখা হয়নি, তুই হয়তো আমার সঙ্গে সুখী হতিস না”। দেখ না এখন কেমন সুখে আছিস,বেশ খেয়ে দেয় মোটা হয়েছিস “বলে হাসতে থাকে সপ্তক”। আর আমাকে দেখ, সেই এক ই জায়গায় যেন আটকে থেকে গেছি আজও। “সুচেতনা চোখ তুলে দেখলো,সেই বকুল গাছটার তলায় ওরা এখন দাঁড়িয়ে।
নিরবতা ভাঙ্গল সুচেতনা। গান গাস এখনও ? সপ্তক গলা ছেড়ে গান ধরলো,”মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়, বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়” সূচেতনাও আর চুপ করে থাকতে পারলো না, “হায় মাঝে হলো, ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়, আবার দেখা যদি হলো সখা প্রানের মাঝে আয়” দুজনেই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন পুরোনো সেই দিন গুলোকে,একটা দিনের জন্য বেঁচে নিচ্ছে।
আজকের পর কে কোথায় আবার চলে যাবে, শুধু এই মুহূর্তটা বড্ড দামি মনে হচ্ছিল সুচেতনার। হঠাৎ করিডোর থেকে দেবশ্রী হাত নেড়ে ওদের ডাকছে দেখে সুচেতনা বললো,”চল,দেবশ্রী আবার ডাকছে কেন দেখি” স্থির দৃষ্টি তে সুচেতনার দিকে তাকিয়ে সপ্তক বললো,”তুই এখনো খুব সুন্দর আছিস রে,এরম ই থাক, ভালো থাক”। সুচেতনা মুখে হাসি এনে বললো,”বুঝলাম,এবার চল,সবাই খেতে বসবে বলে ডাকছে নিশ্চই”।
সপ্তক বললো,”তুই যা,আমি পরে আসছি”
মুখে কপট রাগের ছায়া এনে সুচেতনা বললো,”ও সেই সিগারেট খাওয়া এখনো ছাড়তে পারলি না,বুঝি?” সপ্তক সেই লাজুক, ভুবন ভোলানো হাসিটা হাসলো,বললো,”কি করবো,স্বভাব যায়না ম’লে!”। “ঠিক আছে। খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়, আমি ভেতরে আছি”এই বলে সে করিডোরের দিকে হাঁটা দিলো।
ভেতরে ভেতরে কি যেন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, কেন এমন হলো! কেন ও আর সপ্তক এক হতে পারলো না। করিডোরের মুখেই দেবশ্রী কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলো,”কিরে সুচি তুই কি করছিলিস বুকুল গাছের তলায়?”বলে এসে জড়িয়ে ধরলো দেবশ্রী।
“আমায় যখন ভেতরে বললো, তুই এসেছিস আমি ঠিক জানি তোকে ওখানেই পাবো” এক গাল হাসি দেবশ্রীর। “ওই সপ্তকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম,বল কেমন আছিস? স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো সুচেতনা।
“কার সাথে?”অবাক ভঙ্গি তে জিজ্ঞেস করলো,দেবশ্রী। “আরে সপ্তক রে সপ্তক,ভুলে গেলি? সুচেতনা বলে।
“সুচি আমি তোকে এখানে ডাকতে এসেছিলাম তো ওই জন্যই,আয় আমার সঙ্গে,”বলে সুচেতনার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় দেবশ্রী ওদের ক্লাসরুমের চেয়ারটার সামনে। চেয়ারের সামনে যেতেই চমকে ওঠে সুচেতনা!এ কাকে দেখছে সে! সপ্তকের ছবিতে মালা পরানো, সামনে ধুপ।
“আমি ভাবলাম জল মিষ্টি টা তোর হাত দিয়েই দেওয়াবো,তোদের বন্ধুত্ব তো সবার মনে আছে” দেবশ্রী বললো। সুচি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে ওর।হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,”এ কবে হলো; কিভাবে?।
দেবশ্রী বললো,”আরে হঠাৎ করেই সপ্তকের মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছিল,আমাদের পাড়ায় তো থাকত কাকিমা আর সপ্তক। তো কাকিমা কে নিয়ে গেছিলো হসপিটাল এ,সেদিন তো তোর সঙ্গে দেখাও করার একটা ব্যাপার ছিল না? সেরম ই কিছু বলেছিল সপ্তক, যাইহোক। কাকিমার এমন ই রক্তের গ্রুপ যে এই ব্লাড ব্যাঙ্ক, ওই ব্যাঙ্ক খুঁজেও পাচ্ছিলো না,তাড়াহুড়োয় ভালোভাবে না দেখে রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে একসিডেন্ট এ চলে যায়, কাকিমাও অবশ্য আর বাঁচেননি।
তুই ফার্স্ট,আর ও হয়েছিল সেকেন্ড আমাদের ব্যাচ-এ। আজকের দিনে সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই তো কি আছে,এভাবেও তো তাকে মনে করা যায় নাকি “বলে মিষ্টির প্লেট টা সুচেতনার হাতে ধরিয়ে দিলো দেবশ্রী। সুচেতনা তখনো ঘোরের মধ্যে,তাহলে আজ ও তখন থেকে কার সঙ্গে ছিল!!। সপ্তক এসেছিল ওকে শুধু শেষ বারের মতো দেখবে বলে? একটা দিন সেই আগের মত কাটাবে বলে? ওযে ওর প্রতিশ্রুতি রেখেছিল সেটা জানানোর জন্য?
“সপ্তকের চলে যাওয়ার খবর আমি অনেকভাবে তোকে দিতে গেছি, কিন্তু তুই কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতিস না,তারপর তো একমাসের মাথায় শুনলাম তোর বিয়ে হয়ে গেছে,তাই ভাবলাম আর পুরোনো কথা বাড়িয়ে কি লাভ”!!দেবশ্রী বলে চলেছে…।
সুচেতনার কানে কথা ঢুকছে না। সে উদভ্রান্তের মতো ছুটে যাচ্ছে,”এই সুচি কোথায় যাচ্ছিস, দাঁড়া…আরে। শোন না, কিরে…। “বলতে থাকা দেবশ্রী পেছনেই পড়ে থাকলো। সুচেতনা এক মুহূর্তে ছুটে এসে কলেজের বাঁ দিকে ক্যাম্পাস এ দাঁড়ানো গাড়িটায় উঠে গেল…। চোখ বন্ধ…। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন!! ড্রাইভার কে বলল, “তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো”। কলেজের গেট দিয়ে গাড়িটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল,একবার সাহস করে তাকালো ক্যান্টিনের পেছনের সেই বকুল গাছটার নীচে। হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়ে আছে; অমায়িক হাসি মুখ নিয়ে তার সপ্তক। হ্যাঁ তার…শুধুই তার…।
লেখক-মডারেটর
মধ্যমগ্রাম আমার তোমার গ্রুপ,
মধ্যমগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গ-কলিকাতা।।