
সবুজ অরণ্য। চট্টবাংলা প্রতিনিধি -ঃ
আজ ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের ভয়াল সেই দিন। চারিদিকে লাশের সারি। স্বজনহারা মানুষের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল বাতাস। যেদিকে দূ’চোখ যাই শুধু প্রকৃতির তান্ডবলীলার ক্ষত। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পড়েও উপকূলবর্তী মানুষ সেই দিনটির কথা স্বরণ করে এখনো আতকে উঠে। সেদিন দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী মানুষের জন্য দুঃসহ স্মৃতিময় একটি দিন এটি।
২২শে এপ্রিল ১৯৯১ মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সেদিন
বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্মচাপের সৃষ্টি হয়। বাতাসে গতিবেগ আর নিম্মচাপের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি ২৪শে এপ্রিল রূপ নেয় শক্তিশালী ঘুর্নিঝড়ে। ঘুর্নিঝড়টি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর শক্তি আরও বাড়তে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় এবং গতিবেগ ঘন্টায় ১৬০ মাইল পৌছায়। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে ঘন্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত হানে।
রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে এটা আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উপকূলীয় তীরবর্তী অঞ্চলে প্রায় ঘন্টায় ২৫০কিমি বেগে আঘাত হানার কারণে এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে।স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০শে এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়।
এতে নিহত হন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। যদিও সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি দেড় লাখের মতো। ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী এক মাসে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির প্রভাবে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও লক্ষাধিক মানুষ।
সমগ্র উপকূল জুড়ে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। নিহতের তিন-চতুর্থাংশই ছিল নারী ও শিশু। দুর্যোগের রাতে ভরা পূর্ণিমা থাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়ে উঠেছিল আরও সর্বগ্রাসী। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালী প্রলয়ঙ্ককারী ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
অপূরণীয় সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো এখানকার অধিবাসীরা। সেদিনের তাণ্ডবে মানুষ ছাড়া আরও মারা পড়ে লাখ লাখ গবাদি পশু। নষ্ট হয় বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। ধ্বংস হয় বিপুল সংখ্যক স্থাপনা। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় আক্রান্ত অঞ্চল। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ান ওসব এলাকার বেঁচে যাওয়া অনেকে।
ইতিহাস অন্বেষণে জানা যায়, ১৫৮৪ সালের পর ১৯৬১ সালে গোর্কির মরণ ছোবলে প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলে। এরপর এ অঞ্চলে সাইক্লোন, হারিকেন, জলোচ্ছ্বাস হয় ১৭ বার কিন্তু ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ এ ধ্বংসলীলা ৭০-এর প্রলয়ঙ্করী গোর্কির চেয়েও ছিল বেশি শক্তিশালী ছিল। শিল্প ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
জলোচ্ছ্বাসে সাগর ও নদীর উপকূল ছাড়াও দুকূল প্লাবিত হয় কর্ণফুলী নদীর। কর্নফুলি নদীর তীরে কঙ্ক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলচ্ছাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্নিঝড়ে আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো অংশে বিভক্ত হয়।
বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। প্রায় ১০ লক্ষ ঘড়-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পরে।
উপকূলজুড়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সেই উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। এখনও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ এলাকায় চরম আতঙ্কে বাস করেন এখানকার মানুষ। সেদিন তাণ্ডবলীলার সাক্ষী হয়েছিল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, ফেনী, নোয়াখালী, পটুয়াখালী ও বরিশালসহ ১৩টি জেলার ৭৪টি উপজেলার দেড় কোটি মানুষ।
তবে বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া ইত্যাদী দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। ১৯৭০ এর ভোলা ঘূর্নিঝড়ের পর অনেক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়।
সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও স্থানীয় জনসাধারণের অসচেতনতা ও অজ্ঞাতার কারণে অনেকেই সাইক্লোনের মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে আশ্রয় নেয়। অনেকেই ঝড়ের ভয়াবহতা বেশি হবে না এই আশায় আশ্রয় কেন্দ্রে উপস্থিত হয় নি। ধারণা করা হয় প্রায় ২০ লক্ষ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বিপদজনক স্থানে অবস্থানের কারণে ঘূর্নিঝড়ে আক্রান্ত হয়।
জনসংখ্যার সমানুপাতে আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়নি আজও। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানান, ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে ৩৮টি দেশের বিভিন্ন দাতাসংস্থা থেকে ৪ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার অর্থসহায়তা আসে। ওই টাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।
প্রতি বছর ২৯ এপিল দিনটিকে স্মরণ করে কক্সবাজারে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। ভয়াল এই দিনটির স্মরণে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া সমিতি।

