অশ্রু বড়ুয়া রূপক -ঃ
পাকিস্তানে দুই যুগেরও অধিক সময়
ধরে রাজত্ব করেছিলেন এক বাঙালি। তাঁঁর
সুরের জাদুতে পৃথক দুটি রাষ্ট্রে ছড়িয়েছেন মুক্তো। পাকিস্তানে আইয়ুব খান এর রাজত্ব থেকে মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক এর রাজত্ব। তেমনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানে রাজত্ব করেছিলেন এক বাঙালি। দুই যুগেরও অধিক সময়ের এই রাজত্বে পাকিস্তানের আপামর জনগণ কখনো কেঁদেছে কখনো হেসেছে কখনোবা আবেগে হয়েছে আপ্লুত।
পাকিস্তানের বুকে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানিদের হারিয়ে তিনি জয় করে নিয়েছিলেন-নিগার অ্যাওয়ার্ড। তা-ও একবার দু'বার নয়, ছয়-ছয়বার। হ্যাঁ। রাজনীতির মাঠ দখলে রাখা কিংবা ক্ষমতা আরোহনের জন্যইবা নয়। নয় কোনো যুদ্ধ। শুধুই সুরের জাদুতে পাকিস্তান দখলে নেয়া ওই বাঙালি (একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান) একই সময়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্রে মন্ত্র-মুগ্ধতায় সুরের মূচ্ছর্নায় ছড়িয়েছেন মুক্তো। বিশ্বে একই ব্যক্তির এ রকম উদাহরণ সত্যিই বিরল।
কিংবদন্তী এই মানুষটির নাম-রবিন ঘোষ।
কে বা চিনি অসামান্য প্রতিভাধর এই মানুষটিকে? উত্তরে মিলবে-চেনেন না দেশের অধিকাংশ মানুষ। তবে বিশ্বাস নয়, আমার দাবি থেকেই বলছি-তাঁকে না চিনলেও তাঁর রেখে যাওয়া 'সৃষ্টি' আমাদের অধিকাংশরই বেশ চেনা-জানা শোনা।
১. তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো
২. আমি রূপ নগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি
৩. ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি
৪. আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন
৫. পীচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি
এই রকম অসংখ্য গানের অমর স্রষ্টা, কালোত্তীর্ণ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষ। বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের ইতিহাসের কিংবদন্তী, সাদা মনের মানুষ রবিন ঘোষ'র আজ ৮১তম জন্মবার্ষিকী। আজকের এদিনে সঙ্গীতের মহৎপ্রান রবিন ঘোষ'র স্মৃতির স্মরণে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও অতল ভালোবাসা।
রবিন ঘোষ'র উল্লেখ করার মতো আরও একটি পরিচয় হলো- বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম তাঁর সহধর্মিণী। সঙ্গীতের বরেণ্য এবং অত্যন্ত শক্তিমান এই মানুষটিকে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ না চিনলেও ঠিকই চিনেছে পাকিস্তান। তাইতো পাকিস্তানীরা জীবদ্দশায় মানুষটিকে রেখেছেন মাথায় করে। এইতো ক'বছর আগেও রবিন-শবনম দম্পতিকে পাকিস্তানে দেয়া হয়- 'লাল গালিচা সংবর্ধনা'। রবিন ঘোষ'র মৃত্যুর চার বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০১২ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন'র ৪৭ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই সংবধর্না দেয়া হয়। এছাড়াও তাঁদের হাতে আজীবন সন্মানণা তুলে দেন-পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী।
ইংরেজি ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা। এর মধ্যে জার্মানি কতৃর্ক পোল্যান্ড আক্রমনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অবশ্য চাকুরির পোষ্টিংয়ে এর আগে থেকেই এস এম ঘোষ স্বস্ত্রীক ইরাকে। কাজ করছেন ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস সোসাইটিতে। যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহন করেন রবিন।
তাঁর বাবা-এস এম ঘোষ। মা-আসনাত জিয়া ঘোষ। তিনি ছিলেন একজন বাগদাদি ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি রবিন'র ছিল অদম্য আগ্রহ এবং কৌতূহল। নিয়মিত যাতায়াতও ছিল চার্চে।
সেখানকার কনভেন্ট স্কুলেই শিক্ষাজীবন শুরু করেন রবিন ঘোষ। ইংরেজি ১৯৪৫ সাল। থেমে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ঢাকা তখনও অবিভক্ত ভারতের অংশ। ছয় বছর বয়সী রবিন স্ব-পরিবারে ফিরে আসেন ঢাকায়। পরবর্তীতে শিক্ষাগ্রহনে ঢাকার সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজে ভর্তি হয়ে সঙ্গীত বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
ইংরেজি ১৯৫০ সাল। দেশভাগের পর ঢাকা রেডিও স্টেশন সবে নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এক বন্ধুর মাধ্যমে রবিন ঘোষ রেডিওতে চাকুরির প্রস্তাব পান। ইংরেজি ১৯৬০ সাল। চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম রেডিও স্টেশন পরিদর্শনে আসেন। ওই সময় তিনি রবিন ঘোষকে তাঁর চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করার অনুরোধ জানালে রাজি হয়ে যান রবিন ঘোষ। আর এরি মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে।
'রাজধানীর বুকে' এই চলচ্চিত্রটিতে রবিন ঘোষ ফেরদৌসি রহমানের সাথে যৌথভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ছবিতে তালাত মাহমুদ'র কন্ঠে 'তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো' গানটি ওই সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
পরে বাংলা ছায়াছবি-হারানো সুর, তালাশ, চকোরি, পীচ ঢালা পথ, নতুন সুর, নাচের পুতুল ইত্যাদি ছবির গানে সুরারোপ করেন।ফেরদৌসি রহমানের কন্ঠে 'আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, আব্দুল জব্বারের কন্ঠে "পীচ ঢালা পথটারে ভালোবেসেছি, মাহমুদুন্নবী কন্ঠে 'আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, শাহনাজ রহমত উল্লাহ'র কন্ঠে ফুলের কানে ভ্রমর এসে গানগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্নযুগের গানে বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।
ইংরেজি ১৯৬৪ সাল। যে বন্ধুটির বদৌলতে রবিন ঘোষ ঢাকা রেডিওতে চাকুরি নিয়েছেন ওই বন্ধুর বোন ঝর্না বসাক বাংলা চলচ্চিত্রে তখন টুকটাক অভিনয় করতেন। ঝর্ণা বসাকই পরবর্তীকালে পরিচিতি পান বিখ্যাত অভিনেত্রী শবনম হিসেবে। বন্ধুর সূত্রে শবনমের সাথে রবিনের পরিচয়। শেষতক দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রবিন-শবনম।
এদিকে, এহতেশাম পরিচালিত 'রাজধানীর বুকে' ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে বেশ সফল হয়। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রবিন ঘোষকে। একের পর এক বাংলা ও উর্দু ছবিতে কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি এবং সেগুলো লুফেও নেন। এরই মধ্যে 'তালাশ' ছবির জন্য ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতো নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যান তিনি।
১৯৬৭ সালে 'চকোরি' ছবির জন্যও পান। যা ভারতের ফিল্মফেয়ার সমতুল্য পুরস্কার।
বাণিজ্যিক সফলতার মুখ দেখা 'চান্দা', 'তালাশ', এহসাস, চাহাত, বন্দিশ, দুনিয়া, নাহি আভি নাহি, 'প্যায়সা', 'ভাইয়া', 'তুম মেরে হো' ইত্যাদি জনপ্রিয় উর্দু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন দাপটের সাথে। এদিকে উর্দু ছবির জনপ্রিয় নায়িকা হওয়ার সুবাদে পাকিস্তানে শবনমের তৈরি হয় দারুন এক ক্যারিয়ার।
ইংরেজি ১৯৬৮ সাল। ''তুম মেরে হো' ছবিটি মুক্তির পর রবিন ঘোষ স্বস্ত্রীক পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানেই কাজ করতে থাকেন সাড়া জাগানো সব উর্দু ছবিতে। ১৯৭৭ সালের 'আয়না' ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এ ছবিটি পাকিস্তান চলচ্চিত্রে ইতিহাস হয়ে আছে। সঙ্গীতনির্ভর ছবির তালিকায় শীর্ষে থাকা এই চলচ্চিত্রটি অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন রবিন ঘোষ।
গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কণ্ঠে এ ছবির 'মুঝে দিলসে না ভুলানা' এবং 'ওয়াদা করো সাজনা' এখনও দেশটির মানুষের মুখে মুখে। সব মিলিয়ে প্রায় একশোর বেশি হিট উর্দু ছবিতে সুরারোপ করেছেন রবিন ঘোষ।
১. কাভি তো তুমকো ইয়াদ আয়েগি
২. হামে খোকর বহত পচতাওগে'
৩. সাওন আয়ে'
৪. পেয়ার ভারে দো শর্মিলে নয়ন
৫. দেখো ইয়ে কোন আগায়া
৬. মিলে দো সাথী
৭. সোনা না চান্দি না কোই মহল
৮. দিলসে না ভুলানা
৯. উয়ো খোয়াব সা শাম্মা
১০. ওয়াদা করো সাজনা
-এরকম অসংখ্য গানে জাদু-মাখা সুরের মূর্চ্ছনায় রবিন ঘোষ হয়ে আছেন একজন কিংবদন্তী।
তালাশ (১৯৬৩) ও চকোরি (১৯৬৭)-র পর চাহাত (১৯৭৪) আয়না (১৯৭৭) আম্বার (১৯৭৮) এবং দুরিয়া (১৯৮৪) ছবিগুলোর জন্যও তিনি শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে জয় করে নেন- নিগার অ্যাওয়ার্ড। সব মিলিয়ে ছয়বার তিনি এই পুুরস্কার লাভ করেন।
আশির দশকে ফের স্ত্রীর সাথে ঢাকায় আসা-যাওয়ায় ছিলেন রবিন ঘোষ। পাশাপাশি কাজ করছেন বাংলা ছবিতে। পাকিস্তানি ছবির চাপে খুব বেশি বাংলা ছবিতে কাজ করা হয়নি তবুও ১৯৮৭ সালে 'আপোষ' এবং 'আমার প্রাণেরও সুজন' চলচ্চিত্রের গানে আবারও সুরের মূর্ছনায় বাঙালির মনকে বিমোহিত করেন তিনি। ইংরেজি ১৯৯২ সাল। 'আমার সংসার' নামে বাংলা চলচ্চিত্রটিতে জীবনের শেষবারের মতো সঙ্গীত পরিচালনা করেন রবিন ঘোষ।
ইংরেজি ১৯৯৮ সাল। রবিন ঘোষ স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন ঢাকায়। থাকতেন গুলশানের বাড়িতে। স্ত্রী শবনম ও পুত্র রনি ঘোষকে নিয়ে তাঁর ছিল একান্ত সুখের সংসার। শিল্পী মাত্রই বড্ড অভিমানি। তাইতো জীবনের শেষ সময়গুলো কাটিয়েছেন একান্তে নিরবে নিভৃতে। একবুক অভিমান নিয়েই চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন-সঙ্গীতের এই সাধক।
ইরেজি ২০১৬ সালেের ১৩ সেপ্টেম্বর। গুলশানের কিউর মেডিক্যাল সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুরের জাদুকর রবিন ঘোষ। তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তী। প্রচণ্ড অভিমান নিয়েই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। আমরা পারিনি তাঁকে যথাযথ কাজে লাগাতে। পারিনি মূল্যায়ন করতে। এ যে কতো কষ্টের, কতোটা বেদনার তা আপনিই বুঝে নেবেন। রবিন ঘোষ নামের এই সঙ্গীত সাধক তাঁর রেখে যাওয়া সৃজনশীল কর্মরাশির সূত্র ধরেই যেমনটা আছেন তেমনি থাকবেন চিরকাল।
লেখক- গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। সংগীত পরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা।।
Chief Adviser : Prof. Partha Sarathi Chowdhury. Chairman : Manas Chakroborty. Head Office: 40 Momin Road, Chittagong. Editorial Office: Farid Bhaban (2nd floor), in front of Hajera Taju Degree College, Chandgaon, Chittagong. News Desk : Email : chattobanglanews@gmail.com, Hello : 019-2360 2360
Copyright © 2025 চট্টবাংলা. All rights reserved.