প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ৭, ২০২৪, ১২:২১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০, ১২:৪৪ অপরাহ্ণ
সবুজ অরণ্য। চট্টবাংলা প্রতিনিধি-ঃ
আবহমান কাল থেকে নিজস্ব এক ঐতিহ্য হৃদয়ে লালন করে চলছে চট্টগ্রাম। বীর প্রসবীনি চট্টগ্রাম। বন্দর নগরী এই চট্টগ্রাম। মাষ্টার দা সূর্য্য সেনের চট্টগ্রাম। প্রীতিলতার চট্টগ্রাম। আমরা চট্টগ্রামবাসি তাঁর স্বীয় ঐতিহ্য লালন করে কাটিয়ে দিতে জানি বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ।
আমাদের আছে নানা পার্বণ। মেলা আর উৎসব। পহেলা বৈশাখ যেমন আমাদের প্রাণের উৎসব। তেমনি চট্টগ্রামবাসির আরেক প্রাণস্পন্দন জব্বারের বলি খেলা। ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠজুড়ে এমেলা চলে টানা মাসব্যাপী। এ আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক দলিল। চট্টলাবাসির হাসি-আনন্দ আর কান্নার অনুষদ।
এবারের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মহামারি করোনা কোপ বসিয়েছে আমাদের ঐতিয্যে। আমাদের সংস্কৃতিতে। দেয়াল তুলেছে সামাজিক বন্ধনে। গলা টিপে ধরছে আমাদের উচ্ছাসে। আমাদের করে রেখেছে একঘরে। আমাদের চীর ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখকে আমরা আলিঙ্গন করতে পারিনি বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছাসে। আরেক চট্টল ঐতিহ্য "জব্বারের বলি খেলা" তাও আজ অনেকটা নিরবে কেটে গেল। কেটে আজ তার ১১১ তম জন্মদিন।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী "জব্বার আলীর বলী খেলা'র" ইতিহাস শত বছরের ইতিহাস। এ এক বিশেষ ধরনের কুস্তিখেলা। যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতি বছর আজকের এইদিনে (১২ বৈশাখ) অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহনকারীদেরকে বলা হয় বলী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিই বলী খেলা নামে পরিচিত।
যার যাত্রা শুরু হয় ১৯০৯ সালে। চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর তাঁর জীবর্দশায় এই মেলা বা প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত লালদীঘির জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয়ও এখনো ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত।
এ-বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা। যার ইতিহাসেও প্রচীনত্বের আভাষ পাওয়া যায়।
ইতিহাস নির্ভরতায় জানা যায়, তৎকালীন অভিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুব-সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর নিজ নামে এবলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তণ করেন।
ব্যতিক্রমধর্মী এক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। মল্ল পরিবার ও বলীখেলা একসূতোয় বাঁধা। চট্টগ্রাম বলির দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খনদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাঁচ মল্ল, কাঞ্চন নগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমাম চরের ইমাম মল্ল, নাই খাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈড়লার চুয়ান মল্ল অন্যতম।
বর্তমানে পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখীমেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়।
আজকের লালদীঘি পাড় ও তার আশপাশের এলাকা নিরবতার চাঁদরে ডাকা। অথচ এমনটি কথা ছিলনা। কথাছিলনা চট্টলাবাসি গৃহবন্দী হয়ে থাকার। কথাছিলনা অনেক কিছুই। কিন্ত একটি মানব বিধংশী অজ্ঞাত ভাইরাসের কাছে আমরা আজ অসহায়।
যেখানে পহেলা বৈশাখ ডিসি হিলে বর্ষবরণ উৎসব শেষ করেই সারাদেশ থেকে আসা নানা লোকজ সামগ্রী বিক্রেতারা আসন গাড়ার কথা জব্বারের বলি খেলার মাঠ ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকা জুড়ে তা আজ নিষ্প্রাণ-নিস্তব্ধ। নেই ঢাকের শব্দ। নেই বাঁশির সুর। নেই গৃহীনিদের তৈস্বজ পত্র নিয়ে ঘরে ফেরার দৃশ্য।
আবারও আসবে সুদিন। আবারও জমবে মেলা লালদীঘির খোলা মাঠে। জমবে বলিদের আসর। বসবে মেলা। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। সব। সবই।
এখনো আশায় বাঁধি বুক, "একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথীবি আবার শান্ত হবে"।
শুভ জন্মদিন। আজ তোমার ১১১ তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা তোমায়। ভালোবাসা অফুরান। যুগ যুগ জিয়ো তুমি। যুগ থেকে যুগান্তর। চট্টল ঐতিহ্য জব্বারের বলি খেলা।
তথ্য সূত্র ও ছবি-উইকিপিডিয়া আর ইন্টারনেট।
Chief Adviser : Prof. Partha Sarathi Chowdhury. Chairman : Manas Chakroborty. Head Office: 40 Momin Road, Chittagong. Editorial Office: Farid Bhaban (2nd floor), in front of Hajera Taju Degree College, Chandgaon, Chittagong. News Desk : Email : chattobanglanews@gmail.com, Hello : 019-2360 2360
Copyright © 2024 চট্টবাংলা. All rights reserved.