প্রিন্ট এর তারিখঃ এপ্রিল ৮, ২০২৫, ৮:২১ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০, ১২:১৮ অপরাহ্ণ
![]()
সবুজ অরণ্য। চট্টবাংলা প্রতিনিধি -ঃ
সময়টা ১৯৭২ সাল। লোকসংগীত শিল্পি, গীতিকার ও সুরকার রতন কাহার তখন সদ্য যৌবনে পা রাখা তরুণ। ভারতীয় সংগীত জগতের অনেক গুণী শিল্পী গেয়েছেন তাঁর গান। পাহাড়ি সান্যাল, আর্য চৌধুরী, আনন গোষ্ঠীর রাজকুমার সাহারা। গেয়েছেন শিল্পী পূর্ণচন্দ্র দাস বাউলও।
চাঁদপানা ছোট্ট মেয়েটার একঢাল চুলে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে নিজের ট্র্যাজিক জীবনের কাহিনি তরুণ লোকশিল্পীকে শোনাচ্ছিলেন এক কুমারী মা। পিতৃপরিচয়হীন নিজের একরত্তি মেয়েটা সম্পর্কে কথায় কথায় বলেছিলেন কুমারী মা, ‘এই যে এত্ত চাঁদ রূপ মেয়ের৷ হবে না কেনে? ই বড়লোকের বিটি আছে বটেক’। এই গল্প থেকেই জন্মায় কালজয়ী সেই গান-
" বড়লোকের বিটি লো / লম্বা লম্বা চুল;
এমন মাথা বিন্ধে দিব / লাল গেন্দা ফুল৷"
১৯৭৬ সালে গানটির রেকর্ডিং করেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ অশোকা রেকর্ড কোম্পানির সেই গান লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে৷ জিতে গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কারও৷ এখনও একই রকম জনপ্রিয় গানটির স্রষ্টা রতন কাহার শুরুটা করেছিলেন আলকাপ দিয়ে। যাত্রার দলে ‘ছুকরি ’ও সাজতেন৷ পরে তৈরি করেন ভাদু গানের দল৷ বেঁধেছেন অজস্র ঝুমুর গানও৷ পুরস্কার ও শংসাপত্র এতটাই পেয়েছেন, যে একচিলতে ঘরে তা আর রাখার জায়গা নেই৷ তবে সরস্বতীর বরপুত্রদের লক্ষ্মীলাভ হওয়া সহজ নয়৷
এমন ব্যস্ত মানুষটারই একসময় গানের প্রতি অনীহা চলে আসে সাংসারিক কারণে৷ নিরন্তর দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বন্ধ হয়ে যায় গান বাঁধা৷ তবে তা কাটিয়েও ওঠেন একসময় কিন্তু খ্যাতি জোটেনি আর আগের মতো৷ একটা সময়ে বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা মানুষটা বিড়ি বেঁধে সংসার চালিয়েছেন৷ অভাব অনটন তাঁর নিত্যসঙ্গী জীবনভর৷ তিন ছেলে এক মেয়ের কেউই মাধ্যমিকের গন্ডি টপকাতে পারেনি পয়সার অভাবে৷ মেয়েটা ভালো গান গায়, কিন্তু একটা হারমোনিয়ামও কিনে দিতে পারেন নি৷ এখনও মেয়ের বিয়ে বাকি৷ এখন আর বিড়ি বাঁধার ক্ষমতা নেই৷ সরকারি ভাতা এবং অনুষ্ঠান করে যা পান তা দিয়েই জীবন চলে। তলিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে৷
লোকসঙ্গীতের সমঝদার বাদে আমজনতার ক’জন শুনেছেন রতন কাহারের নাম?
সেই কুমারী মা নিজের জীবনের সব গল্প বলেছিল রতনকে৷ ওর আশ্রয়দাত্রী ছিল হরিদাসী৷ সেই প্রৌঢ়ার একটা ঝুমুরের দল ছিল৷ ওর কাছে সুর নিতে গিয়ে তখনই আলাপ৷ সেই তরুণীর গল্পে এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন, যে গানটা লেখার সময় ওই গল্পটাই মাথায় ঘুরছিল৷
ইশারায়-ইঙ্গিতে সেই কুমারী মেয়েকে বাবুর বাগানে দেখা করতে বলত তার প্রেমিকটি৷ অল্প বয়সে না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে মেয়ে৷ যখন টের পায় শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে, তখন পিতৃত্ব অস্বীকার করে প্রেমিক৷ সে তো তথাকথিত বড় ঘরের৷ তাই তার ঔরসে জন্মানো নিষ্পাপ শিশুটিকে উদ্দেশ্য করেই তৈরি হয় "বড়লোকের বিটি লো" গানটি।
রতন কাহার একসময় চুটিয়ে কাজ করেছেন আকাশবাণীতে৷ পাহাড়ি সান্যালই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন আকাশবাণীতে। নিয়মিত কাজ করেছেন তখন। অভিমান জড়ানো গলায় বলেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেকেই ব্যবসা করেছেন৷ আমার লেখা, আমার বাঁধা গান নিয়ে এসে রেকর্ড করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ সবাই আশ্বাস দেন৷ কিন্তু কিছুই হয় না৷" আবার মুহূর্তেই অবশ্য অভিমান গায়েব হয়ে শিশুসুলভ সারল্য ঝরে পড়ে উনার কণ্ঠে, ‘ওঁরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন৷ পাহাড়ি সান্যাল, আর্য চৌধুরী, আনন গোষ্ঠীর রাজকুমার সাহারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন৷ আনন গোষ্ঠীর সঙ্গেই এসে খাতায় বড়লোকের বিটি লো গানটা লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ তবে তিনি রেকর্ড করার আগেই আমি গানটা গেয়েছিলাম রেডিয়োতে।"
যাঁরা চিনেছেন -বুঝেছেন, তাঁরা কাজ দিয়েছেন৷ তবে ধীরে ধীরে কাজ কমতে শুরু করে৷ প্রসার ভারতী তাঁর অনুষ্ঠানটা বন্ধ করে দেয়। পুরোনো মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অন্য জায়গায় চলে গেলেন৷ তাতে নিজেরটুকু চলে৷ ঝুমুর -ভাদুতে ডুবে রয়েছেন এখনও৷ নতুন প্রজন্ম খোঁজ নেয়।
শিল্পী শীলা জিৎ'র জন্য ভাদু গান লিখেছিলেন৷ হাজার তিনেক টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন হাতে৷ বিদ্যাসাগর কলেজে অনুষ্ঠান করে খুব প্রশংসাও পান, সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে রতনের কথা শুনেছিলেন কালিকাপ্রসাদ৷ ২০১৭ এর মার্চে রতন কাহারের বাড়িতেই আসার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি চলে যান৷
অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা লোকসংগীত শিল্পী রতন কাহার বেঁচে আছে, না মরে গিয়েছে,কেউ কি জানেন? যে মানুষটা গান কে তার নিজের কন্যাসম মানতেন, গানের কথা সুর কাউকে নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতেন, বদলে কেউ টাকা দিতে এলে বলতেন, "আমি বিটি বিচে টাকা লুবো না।" কেউ জানতেও চায় না আর সেই মানুষটার কথা।
আজ অত্যন্ত লজ্জার বিষয়, আবার বাংলা লোকসংস্কৃতির অপমান চাক্ষুষ করতে হলো আমাদের, কোনো ক্রেডিট ছাড়াই সেই বিখ্যাত দুই লাইন চুরি হয়ে গেলো Sony Music এ, নেই কোনো প্রতিরোধ, নেই কোনো কপিরাইট ক্লেইম।কোনোকালেই রতন কাহারের অনবদ্য সৃষ্টি এবং প্রতিভার মর্যাদা তো দিতে পাড়লোই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। উল্টে তার কালজয়ী সৃষ্টির দু'লাইন, এক চটকদার হিন্দি গানের পাঞ্চলাইন হিসেবে বাংলা সংস্কৃতির ছেলেখেলার এক জঘন্যতম নিদর্শন হয়ে থেকে গেলো। প্রকৃতপক্ষে গান্দা ফুল গানের রচয়িতা রতন কাহার হলেও, লাইন চুরি করে গীতিকার ও সুরকারের নামের স্থলে লেখা হয়েছে বাদশা নামটি। এটাই কি পাওনা ছিলো রতন কাহার'র।
Chief Adviser : Prof. Partha Sarathi Chowdhury. Chairman : Manas Chakroborty. Head Office: 40 Momin Road, Chittagong. Editorial Office: Farid Bhaban (2nd floor), in front of Hajera Taju Degree College, Chandgaon, Chittagong. News Desk : Email : chattobanglanews@gmail.com, Hello : 019-2360 2360
Copyright © 2025 চট্টবাংলা. All rights reserved.